সরকারি প্রকল্প ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ মূলত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি আর্থিক সহায়তা প্রকল্প যা শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু সেই প্রকল্পে এক কিশোর ছেলের নামে চার বছর ধরে টাকা ঢুকছে—এমনই বিস্ময়কর দাবি করলেন মালদহ জেলার কালিয়াচক ১ নম্বর ব্লকের যদুপুর পঞ্চায়েতের নয়াগ্রামের বাসিন্দা আমানুর রহমান। এই অভিযোগের পর গোটা এলাকা তোলপাড়, তদন্ত শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।

IMG 20250514 192534

লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা কিভাবে ছেলের নামে ঢুকছে?

আমানুর রহমান জানান, প্রতিদিনের মতোই তিনি নিজের মোবাইল ফোনে স্ত্রীর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের স্ট্যাটাস চেক করছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি দেখতে পান, একই মোবাইল নম্বরে তাঁর স্ত্রীর পাশাপাশি আরও একটি নাম যুক্ত আছে—তা হল তাঁর ছেলের। কিন্তু, সরকারিভাবে এই প্রকল্প শুধুমাত্র ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে মহিলাদের জন্যই বরাদ্দ।

এখানেই চমক। তাঁর ছেলের নামের বানান সামান্য পরিবর্তিত, আর অ্যাকাউন্ট নম্বরটিও আলাদা। সন্দেহ জাগে। তখন তিনি পুরো Beneficiary ID কপি করে খোঁজখবর শুরু করেন, এবং আবিষ্কার করেন—২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিনিয়ত সেই নাম ব্যবহার করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা তোলা হচ্ছে!

চক্রের ফাঁদে আধার ও মোবাইল নম্বর?

ঘটনা থেকে পরিষ্কার, কেউ বা কারা আমানুরের ছেলের আধার নম্বর এবং তাঁর নিজের ফোন নম্বর ব্যবহার করে এই প্রকল্পে ভুয়ো আবেদন করে এবং দীর্ঘদিন ধরে সেই টাকাগুলি উত্তোলন করে আসছে। আমানুরের বক্তব্য, “আমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করার পর সে জানায়, কাউকে সে কোনো নথিপত্র দেয়নি। আমি নিশ্চিত, অসাধু একটি চক্র এই জালিয়াতি করেছে।”

প্রশাসনের পদক্ষেপ ও তদন্তের অগ্রগতি

এই ঘটনার পর আমানুর ব্লক অফিস ও কালিয়াচক থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। জেলা শাসকের দফতর থেকেও তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনও ইতিমধ্যেই প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে। আধার কার্ড, মোবাইল নম্বর ও ব্যাঙ্ক একাউন্টের তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে কোথা থেকে এবং কার মাধ্যমে এই প্রতারণার সূচনা হয়েছিল।

ঘটনার সম্ভাব্য কারণ ও প্রতারণার রূপ

এই ধরনের জালিয়াতির পেছনে বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে:

📌 সম্ভাব্য কারণ🔎 বিশ্লেষণ
আধার কার্ড ক্লোনিংআধার নম্বর জাল করে ভুয়ো আবেদন দাখিল
সাইবার ফিশিংমোবাইল নম্বর ব্যবহারের মাধ্যমে OTP চুরি
ভুয়ো নাম ব্যবহারছেলের নাম সামান্য বদলে প্রকল্পে নাম তোলা
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বদলআসল ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর

রাজনৈতিক তরজা: তৃণমূল বনাম বিজেপি

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা।
👉 বিজেপির মালদহ জেলা সম্পাদক অম্লান ভাদুড়ি বলেন:

“তৃণমূল সরকারের প্রকল্পেই দুর্নীতির চূড়ান্ত উদাহরণ। শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ হোক বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সর্বত্রই দুর্নীতি। মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের কথা বলেন, কিন্তু নিচুতলার কেউ তা মানে না।”

👉 অন্যদিকে তৃণমূলের জেলা মুখপাত্র আশিস কুন্ডু জানান:

“মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্পে মহিলারা উপকৃত হচ্ছেন। অভিযোগ সত্য হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কেউ ষড়যন্ত্র করে প্রকল্পের বদনাম করার চেষ্টা করলে সেও ছাড়া পাবে না।”

আইনি দৃষ্টিকোণ: কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়?

এই ধরনের প্রতারণা, যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করা যেতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • আই.পি.সি. ধারা 420 (প্রতারণা)
  • আই.টি. আইন, 2000 – ধারা 66 (সাইবার অপরাধ)
  • আধার অ্যাক্ট অনুযায়ী তথ্য অপব্যবহার

সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা হতে পারে।

জনসচেতনতার বার্তা:

এই ঘটনার পর সাধারণ নাগরিকদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন:

✅ সরকারি প্রকল্পে আবেদন করার সময় নিজে থেকেই যাচাই করে নিন
✅ কারও সঙ্গে আধার নম্বর, মোবাইল নম্বর, ব্যাঙ্ক তথ্য শেয়ার করবেন না
✅ প্রয়োজনে স্থানীয় CSC কেন্দ্রে গিয়ে স্টেটাস চেক করুন
✅ সন্দেহ হলে তৎক্ষণাৎ থানা ও ব্লক অফিসে অভিযোগ জানান

উপসংহার:

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে এই ধরনের জালিয়াতির ঘটনা শুধু প্রশাসনিক নয়, সমাজিক সচেতনতার বড় প্রশ্ন তুলে দেয়। আমানুর রহমানের অভিযোগ সামনে আসার পর রাজ্য জুড়ে এই প্রকল্পে আরও বহু ভুয়ো একাউন্ট থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়াই হবে প্রকৃত ন্যায়ের প্রয়োগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *